এন্টিথিসিস
দ্বিতীয় পর্ব
মেয়েটার সাথে আলাপটি আর না এগোলেও আমার মাথায় চিন্তাটা চলতে থাকে। আমার কাঁধে ওর হাতের ছোঁয়া এবং তারপর ওর হাতের সৌন্দর্য আমাকে বিভোর করে রাখে। আমার মনে হয় ওর হাতটা যে এত সুন্দর যেটা একটা মহাজাগতিক মিরাক্যাল। ওর হাতের পিঠে যে লোম সেটাও এত মোলায়েম, সেই লোমের বিন্যাস থেকে চামড়ার রেখা, আঙুলের মসৃন কার্ভ, নখের আকৃতি, তালুর পেলবতা, হাতের তালুর, আঙুলের ভাঁজের রেখাগুলো, তাদের মধ্যকার যে মোলায়মেম কার্ভগুলো - পুরোটাই যেন এক সুক্ষ শিল্পকর্ম। সেই হাতের যো মুভমেন্ট, সেই হাতের যে মূদ্রা, যেভাবে ও হাতটা নাড়ায়, হাতটা কোথাও রাখে, হাত দিয়ে কিছু নির্দেশ করে, আলতো করে একটা কিছু ধরে, কিছু নির্দেশ করে সেগুলোও যেন এক একটি প্রেমের কবিতার ছন্দ।
সেই হাত পেরিয়ে বাহু, স্কন্ধ, গ্রীবা, অবয়ব হয়ে ওর পায়ের পাতা পর্যন্ত - ওর পুরো দেহটার দিকে এগোলে সেই একই সৌন্দর্য্য, সেই একই বিস্ময় এবং একই বিহব্বলতা একই কবিতা আমি যেন দেখি। অথচ ওর দেহের চামড়া ভেদ করে ওর মাংস, পেশী, হাড়, হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, প্লিহা, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র সবকিছু যেন আমার মতই, কোন ভেদ নেই। শুধু তাই নয়, আকার ছাড়া তেমন প্রভেদ নেই একজনের সাথে আর একজনের। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অপারেশন থিয়েটারে সার্জনের হাতে থাকা ট্রেতে রাখা অঙ্গ দেখে বোঝা যাবে না সেটা নারী বা পুরুষের অথবা প্রিয়তমার অথবা চরম শত্রুর - কারণ সবগুলো দেখতে হয় একই রকম।
তার মানে ওর যে সৌন্দর্য্য, যেটা আমাকে অভিভূত করে রেখেছে সেটা বাহ্যিক সোমেটিক বিউটি, সেটা দেখার রূপ, শোনার রূপ, অনুভবের রূপ। নারী হিসাবে ওকে বিশেষ করে বানানো হয়নি, নারী হিসাবে বংশ পরাম্পরায় ওর পূর্বসূরীরা বাছাইকৃত হয়েছে মানব অনুভবের আবেগ দ্বারা। সোমেটিক সৌন্দর্য্যের বিষয়টা তাই প্রজন্মের পর প্রজন্মে উন্নততর হয়েছে, হয়েছে আরো আকর্ষণীয় মনোহরণকারী।
নারীর প্রতি পুরুষের এই আকর্ষণকে বেদ উপনিষদের ধর্মতত্ত্বে খুব উচ্চ মূল্য দেওয়া হয়েছে। নারী পুরুষের প্রেম ও মিলন সেখানে কেন্দ্র, প্রেমই লক্ষ্য। অথচ নারীকে শয়তানের আমন্ত্রণকারী এবং পাপের কেন্দ্র এবং নারীর রূপে বিমোহিত না হতে বলা হয়েছে আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে। আশ্চর্যজনকভাবে ব্রহ্ম স্বত্ত্বা কিন্তু নারীও নয় পুরুষও নয় অথচ আব্রাহিমিক ইশ্বর পুরুষকে তৈরি করেছেন নিজের অনুকরণে তবুও নারীর সৌন্দর্য সেখানে নেতিবাচক।
কিন্তু এগুলো সবই ধর্মগ্রন্থের কথা ধর্মীয় মিথ অনুসারে। কোথা থেকে কেমন করে এইসব ধারণা মানুষের মনে প্রথম এল তার কি কোন ঐতিহাসিক, নৃবিদ্যা বা বিজ্ঞান সম্মত তথ্য সূত্র আছে? আধুনিক হিন্দু ধর্মীয় অনেকে অস্বীকার করলেও বেদ উপনিষদের যে ব্রহ্ম স্বত্ত্বা, সেই চূড়ান্ত জ্ঞান সত্তা, সেটা ইরানের প্রাচীন ধর্ম জরথুস্ত্রবাদের “আহুরা মাজদা” যার অর্থ "সর্বজ্ঞানস্বামী", সেই ধারণার সূত্রে এসেছে। এই ধারণা যাযাবর আর্যদের ইরান এলাকা থেকে থেকে ভারতবর্ষে আসার যে ইতিহাস সেটার সাথেও মিলে যায় যারা বৈদিক সভ্যতার সূচনা করে যার লক্ষ্য ছিল পরম জ্ঞান।
বেদ উপনিষদের ব্রহ্ম বা জরাথুস্ত্রবাদের আহুরা মাজদার যে চূড়ান্ত জ্ঞানসত্তার একেশ্বরবাদ সেটা আব্রাহিমিক একেশ্বরবাদের সাথে মেলে না। বেদ উপনিষদের ব্রহ্ম যখন মানব জীবনের লক্ষ্য নির্দেশ করে তখন তাকে এক কথায় বলা হয় "সচ্চিতানন্দ" এই শব্দে যার অর্থ "সত্য - চেতনা - সুখ"। যার সরলার্থ হলে মানুষকে চলতে হবে সত্যের বা জ্ঞানের পথে, সচেতন হয়ে এবং আনন্দের সাথে। আব্রাহিমিক ঈশ্বরের যে নির্দেশ “পড়, আল্লাহর নামে”, সেটা ধর্মগ্রন্থ পড়ার জন্য বলা হয়েছে, মুক্ত জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়। বেদ উপনিষদের ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে ব্রহ্মজ্ঞান যিনি লাভ করেন তাকে বলা হয় ব্রাহ্মণ। তার প্রতিচরিত্র হল কৃপণ - যার অর্থ যার জ্ঞান নেই।
অথচ আব্রাহিমিক ধর্মগুলো সম্পর্কে যারা জ্ঞানী, সেই রাবাই, পাদ্রী অথবা ইমাম, তাঁদের প্রতিচরিত্র হলো যারা ঈশ্বরকে অস্বীকার করে। যেমন শয়তানের অনুগত যারা বা ঈশ্বরের নিয়মকানুন অবজ্ঞা করে যারা। অর্থাৎ এখানে ঈশ্বরকে স্বীকার করা এবং ঈশ্বরের নিয়মকানুন জানা ও মানা গুরুত্বপূর্ণ, বেদ উপনিষদ বা জরাথুস্ত্রবাদের মত সর্বজ্ঞান বা ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন নয়। আরবীতে ইসলাম শব্দের অর্থ “অনুগত হওয়া” বা "আত্মসমর্পণ" করা (আল্লাহর প্রতি)।
এই সব বিষয়গুলো খেয়াল করলে দেখা যায় আব্রাহিমিক ধর্মগুলোর মূল আসলে কোন দর্শন নয়, এটা প্রতিদর্শন। বেদ উপনিষদের ব্রহ্ম বা জরাথুস্ত্রবাদের আহুরা মাজদার যে বিমূর্ত রূপ, ধন দৌলত আহরন, বিলাসী জীবনযাত্রার ফলে সচ্চিতানন্দের সত্য, চেতনা ও সুখের মধ্যে সুখ ছাড়া মানুষ সত্য ও চেতনা বোধের ক্ষমতা হারায়। দেখা যায় এর ফলে ধন দৌলত আহরন, ভোগ নির্ভর জীবনযাত্রা বিশেষ করে শহুরে বিলাসিতা বেড়ে যায়। এর ফলে ধনী এলিটদের অবিচার ও নিপিড়নের একটি বিশেষ সময় বা পরিস্থিতি তৈরী হয়। তখন মানুষ মুর্তি, ভাবমূর্তি ও ঈশ্বরের বস্তুপ্রতিবিম্ব বা অবতার বানিয়ে তার পুজা শুরু করে। সচ্চিতানন্দের সত্য, চেতনা বাদ দিয়ে শুধু সুখের পেছনে ছোটে। প্রকৃতিগতভাবে মানব চরিত্র বা মানব সমাজ যে এই সংকীর্ণ ভোগবাদী দর্শনের পথে যাত্রা শুরু করে, আব্রাহামিক ধর্মগুলো এরই প্রতিদর্শন বা বিরোধাভাস।
আব্রাহিমিক ধর্মগুলোর এই প্রতিদর্শন বা বিরোধাভাসর তাহলে মূলটা কোথায়? ধর্মগ্রন্থের ভেতর থেকে বা ধর্মীয় মিথ থেকে সব প্রশ্নের হয়ত জবাব পাওয়া যাবে না। এর জন্য খুঁজতে হবে নৃতত্ব, প্রত্নতত্ব ও আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ থেকে ধর্মেগুলোর ইতিহাস ও সামাজিক পরিপ্রক্ষিত পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যও।
ঐতিহসিকভাবে আব্রাহামিক ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনা বা স্থানের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন মিলেছে খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি দিকের। সেগুলো কোথায় ঘটেছে, সেইসব স্থানের যারা বাস করত তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্বিক পরিস্থিতি কেমন ছিল সেটা যদি আমরা বুঝতে পারি তাহলে আমরা ধারণা করতে পারব আব্রাহিমিক ধর্মগুলোতে যে প্রতিদর্শন বা বিরোধাভাসর কথা বলা হচ্ছে সেটা আসলে কিসের বিরুদ্ধে।
আব্রাহামিক ধর্মগুলোর শুরুটা হয়েছে ইহুদী ধর্মের প্রসারের মাধ্যমে। যেটি পরবর্তীতে খ্রীস্টধর্মে রূপ নেয়। এবং সেই একই দর্শন, একই সৃস্টিতত্ব, একই মহাবিশ্বধারণা ও একই পরিণামের ধাারণা নিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রবর্তিত হয় খ্রীস্টাব্দ প্রথম মিলেনিয়ামের শেষের দিকে। ইহুদী ধর্মের মূল নীতিগুলো মিথিক্যাল গল্প (ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ইতিহাস) হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে হিব্রু বাইবেলের প্রথম পাঁচটি গ্রন্থে যেগুলো হলো জেনেসিস (সৃস্টি), এক্সোডাস (দলবদ্ধভাবে প্রস্থান), লেভিটিকাস (ধর্মীয় আইনকানুন), নাম্বারস (জনমিতি) এবং ডিউটরনমি (দ্বিতীয় নীতি)।
এই পাঁচটি গ্রন্থকে একসাথে তোরাহ বলা হয় যেটি আমাদের কোরআন যেমন নবী মুহম্মদ কতৃক প্রবর্তিত হয়েছিল এগুলো তেমনই নবী মুসা কতৃক একই আল্লাহ হতে প্রবর্তিত হয়েছে। কোরআনে বর্ণিত আছে নবী মুহম্মদ যেমন একই সাথে নবী ও রাসুল, নবী মুসাও তেমন অর্থাৎ তিনিও আল্লাহর নির্বাচিত ব্যক্তি এবং বার্তাবাহক।
নবী মুসার প্রবর্তিত পাঁচটি গ্রন্থে যে দর্শন, মিথ ও নিয়ম কানুনের বর্ণনা আছে আব্রাহামিক তিনটি ধর্মই সেটা হুবহু অনুসরণ করে। এর প্রথমটি জেনেসিসে আছে ঈশ্বরের দুনিয়া সৃষ্টি, আদম ও হাওয়াকে সৃষ্টি, বেহেশতে আদম হাওয়ার জীবন, সর্পরূপী শয়তানের প্ররোচনায় প্যাশন ফল ভক্ষণ, বেহেশত হতে বিতাড়ণ, আদমের ছেলে মেয়ে হওয়া, তাদের মধ্যে সম্পর্ক, নারীসঙ্গ লোভে আদম পুত্রের তার ভাইকে প্রথম খুন, মহাপ্লাবন ও নুহ নবীর নৌকা, ইহুদি রাজ্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে নবী ইব্রাহিমের আবির্ভাব, ইব্রাহিম পুত্রকে কোরবানীর ইতিহাস এগুলো সব লিপিবদ্ধ। দ্বিতীয় গ্রন্থ এক্সোডাসে আছে মিশরে দমনমূলক ও অন্যয্য অন্যায়কারী মিশরীয় রাজাদের অধীনে ইহুদিদের দাস জীবন এবং জসুয়া নামের এক দাস কতৃক বিদ্রোহ এবং মুক্তির পর নবী মুসার নেতৃত্বে দলবদ্ধভাবে মিশন থেকে প্রস্থান।
আব্রাহামিক ধর্মগুলের প্রাথমিক ধর্মগ্রন্থগুলো বিশ্লষণ করলে দেখা যায় আব্রাহামিক ধর্মগুলোর কেন্দ্রে যে থিসিস বা প্রসঙ্গ সেটি এক্সোডাসে বর্ণিত। সেটি হল ধনী, এলিট ও অন্যায্য শাসকগোষ্ঠীর দরীদ্র ও অসহায়দের উপর জুলুম ও অবিচার। বাকি গ্রন্থগুলো সেই থিসিসকেই জাস্টিফাই করার জন্য।
আব্রাহামিক ধর্মগুলো মৌলিকভাবে সিটি স্টেটের শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় অত্যাচারের বিরোদ্ধে সাধারণ জনগণের বিপ্লব ও বিজয়ের বার্তা বহন করে। এগুলো কিসের প্রতিদর্শন বা বিরোধাভাস প্রচার করে সেটা এক্সোডাসে স্পষ্ট। সেটা হল বিবেচনাহীণ ধনী ও মনুষ্যত্যহীন শাসক বা অভিভাবক হবার ফলে মানুষের অসীম ক্ষমতা প্রাপ্তী ও ধনিক জীবনের এটা প্রতিদর্শন। জ্ঞান ও ধন দৌলত যদি মানুষকে অসীম ক্ষমতা প্রাপ্তীর দিকে নিয়ে যায় তাহলে আব্রাহামিক ধর্মগুলে জ্ঞান ও ধন দৌলতেরও বিপক্ষে প্রতিদর্শন।
এক্সোডাসে বর্ণিত কাহিনীতে দেখা যায় মিশরে অত্যাচারী ফেরাওদের থেকে শ্রমিক ও সাধারণ মানুষেরা শ্রমিক জসুয়া ও ফেরাও পরিবারে পালিত মুসার নেতৃত্বে মুক্তি ছিনিয়ে নিয়ে বের হয়ে যায় তখনকার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ধনীদের শহর থেকে। নবী মুসার নেতৃত্বে তারা পায়ে হাঁটতে থাকে নিরুদ্দেশ প্রান্তরে ঈশ্বরের সেই ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’র উদ্দেশ্যে যেটা নবী ইব্রাহীম প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন। এভাবে তারা বর্তমান জর্ডানের মোয়াবে পৌছালে সেখানে নিবু পর্বতের চুড়ায় উঠে নবী মুসা সেই ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ কেনান প্রদেশ দেখতে পান। কিন্তু তার সেই প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। সেখানেই নবী মুসা মৃত্যুবরণ করেন। তার অনুসারীরা যার সংখ্যা ছয় লাখ, তারা তার পর কেনান প্রদেশে গিয়ে ইহুদি জাতীর জন্য একটি নতুন দেশ তৈরী করা শুরু করে।
তারা সেখানে গিয়ে সেই কেনান প্রদেশের বিরাণভূমীতে নগর তৈরি না করে কুঁড়ে বা বস্তি তেরী করে বাস করতে থাকে এবং তারা বর্জন করতে থাকে সবকিছূ যা তারা ধনী, এলিট সমাজে দেখেছে। তারা বাস করতে থাকে কুঁড়ে ও ছাপড়ার জৌলসহীন এবং সকল প্রকার নাগরীক ও ধনী সমাজ সংস্কৃতির, ভোগ, বস্তু ও সংস্কৃতি পরিহার করে। আব্রাহামিক প্রতিশ্রুত ভূমির নিয়ম অনুসারে কেনান প্রদেশের বাসিন্দারা হবে দুনিয়ার জীবনে সকল বাহুল্য বিবর্জিত যারা সব কিছু পাবে তাদের পরকাল বা বেহেশতি জীবনে।
উপরে বর্ণিত এক্সোডাসের বর্ণনা আব্রাহামিক মিথ বা ধর্মগ্রন্থগুলোর বর্ণীত ইতিহাস অনুসারে। নতুন পাওয়া আর্কিওলজিক্যাল নমূনা ও তথ্য বিশ্লেষণ থেকে অনেক বিশেষজ্ঞ এখন এটাই মনে করছেন যে ইব্রাহিমীয় ধর্মগুলোতে যে মুসা নবীর নেতৃত্বে দাসদের মুক্ত হয়ে যে প্রস্থান বা এক্সোডাস সেটা বাস্তবে আদৌ মিশরে ঘটেনি। মিশরের কোন আর্কিওলজিক্যাল নমুনায় বা ঐতিহাসিক টেক্সটে তথ্যে এমন কোন সূত্র মেলেনি বা মিশরে কোন খনন কাজে লক্ষ লক্ষ ইসরাইলবাসীর মিশর ত্যাগের কোন প্রমান মেলেনি। এইসব বিশেষজ্ঞরা বলছেন এক্সোডাস হয়েছে, খ্রীস্টপূর্ব ১৬০০ সালের দিকে তবে সেটা ইসরাইলেই অর্থাৎ প্রাচীন কোনান প্রদেশেই হাজর শহরে সেখানকার শসকদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের মাধ্যমে ইসরাইলের দাস সমাজের বেরিয়ে যাওয়া।
তখনকার শহরগুলো ছিল সিটি স্টেট। হাজর শহরটি ছিল দুই স্তর বিশিষ্ট। একটি ছিল একটি উপতাক্যার উপর উচ্চ শহর আর একটি নিচে, সমতলে নিম্ন শহর। উচ্চ শহরে থাকত অত্যাচারী ধনী অনৈতিক সেচ্ছাচারী এলিট সমাজ যারা ছিল মিশরের ফেরাও নিয়ন্ত্রিত এবং যাদের জীবন যাত্রা ছিল মিশরীয় রাজ সংস্কৃতির মত। আর নিম্ন শহরে থাকত দাস ও দরিদ্র সমাজ। কেনানের হাজর শহরেই দাস জসুয়ার নেতৃত্বে এক বিপ্লবে উচ্চ শহরকে আগুনে জালিয়ে দিয়ে নবী মুসার নেতৃত্বে তারা শুধু হাজর শহরই ত্যাগ করেনি, ধনী এলিটদের জীবনযাত্রাও ত্যাগ করার শপথ নিয়েছে।
হাজরের উচ্চ শহরে ছিল অনেক মিশরিয় দেব দেবতার মুর্তি। তারা সেগুলোতেও আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তারা আর কোন মুর্তির ঈশ্বরকে না বিশ্বাস করার শপথ নেয়। আর্কিওলজিক্যাল নমূনা ও তথ্য বিশ্লেষণ থেকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন পুরো শহরটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আগুন জ্বালানোর আগেই সকল মূর্তি, মন্দির ও প্রাসাদগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা এটাও পেয়েছেন যে ঐ বিদ্রোহ ও আগুনের ঘটনা দুবার ঘটেছিল যার প্রথমটি ছিল এক্সোডাস।
আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে এক্সোডাস খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মুসা নবীর এক্সোডাসের এই ধর্মীয় মিথ আসলে তৈরি করেছে সেই শহুরে এলিট ভোগবাদী জীবনের একটি প্রতিদর্শন বা বিরোধাভাস। সিরিয়া পারস্যের ফার্টাইল ক্রিসেন্ট থেকে কৃষিকাজ শিখে যাযাবররা যখন ইন্ডাস নামক নদীর পাড়ে থিতু হয়েছে তখন তারা জরাথুস্ত্রবাদের আহুরা মাজদা বা বেদ উপনিষদের ব্রহ্ম প্রভাবিত "সচ্চিতানন্দ" যার অর্থ "সত্য - চেতনা - সুখ" কেই জীবনের লক্ষ্য করেছে। যার সরলার্থ হল মানুষকে চলতে হবে সত্যের বা জ্ঞানের পথে, সচেতন এবং আনন্দের সাথে।
সেই মানুষেরা জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে জীবনের সরল সত্য, চেতনা ও সুখের পথে না গিয়ে জ্ঞানকে ধন, দৌলত, প্রতিযোগীতা, উপভোগের লক্ষ্যে সম্পদ আর ক্ষমতা অর্জনের কাজে লাগিয়েছে। তৈরি করেছে প্রাসাদ, অট্টালিকা আর শহুরে জীবন। শহুরে সমাজ হয়ে উঠেছে ধনীর অর্থ ক্ষমতার কাছে সাধারণ মানুষের দাসবৃত্তি ও অসহায়ত্বের প্রতিশ্রুত ভূমি যেন। এই অসহায়ত্ব সৃষ্টিকারি ধন ও ক্ষমতা তৈরি করেছে অবিশ্বাস, শঠতা, অন্যায় ও দমন নিপিড়ন ও লুটপাটের রাজ্য।
জরাথুস্ত্রবাদের আহুরা মাজদা বা বেদ উপনিষদের ব্রহ্ম এবং সেখান থেকে "সচ্চিতানন্দ" একটি প্রি আরবান, অথবা নগরায়ণের পূর্বের একটি খোলামেলা গঠনমূলক দর্শন যা আমাদের পশুসত্ত্বা থেকে চিন্তাশীল মানুষে পরিণত করেছে। যেটা আমাদের বস্তু-অনুভবের জগত থেকে বিমূর্ত-ভাবের জগতে নিয়ে যাবে। কিন্তু শহরগুলো তৈরি হবার পর সেটা পথ হারায় ভোগবাদী শহুরে জীবনে। বস্তু আর ভোগ হয়ে ওঠে জ্ঞানের লক্ষ্য। তখন যে অন্যায়, অবিচার ও নিপিড়ণে মানুষ দাসে পরিণত হয়, সেটার বিরুদ্ধে জীবন বিরোধী "সত্য - চেতনা - সুখ" বিরোধী পরকালমুখি নিয়ন্ত্রণই আব্রাহামিক দর্শন।
ফিরে আসি আমাদের গল্পে। আমাদের গল্পের নায়িকার এতসব কঠিন ইতিহাস, দর্শন ও ধর্মকথা জানা নেই। তবুও সে ধার্মিক। সে গভীরভাবে বিশ্বাস করে অন্তর্যামী কেউ নিশ্চই তার কথা গভীর ভাবে শেনেন এবং একদিন তার ইচ্ছা ঠিকই পুরণ করবেন। আধুনিক শহুরে জীবনের যে মনোজাগতিক দাসবৃত্তি ও অসহায়ত্ব, সেটা সে খুব সচেতনভাবে অনুভব করে সেটা মনে হয় না। জীবনের ভোগ উপভোগ ত্যাগ করে পরকালে গিয়ে জীবন উপভোগের যে দর্শন সেটা সে খুব একটা সিরিয়াসলি নেয় বলেও মনে হয় না। বরং স্বাভাবিক আর সকলের মত ভাল খাওয়া ভাল থাকা এবং ধন দৌলত ও প্রভাব প্রতিপত্তি সে অর্জন করতে পারলে সে সেটা উপভোগই করবে। ধর্ম যে ইহলৌকিকতা পরিহার করতে বলছে তার সে একেবারেই বিপরীত।
আমি ওর দিকে তাকাই। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে যদি আমার যা আছে সব কিছু ফেলে ওর সাথে কোন প্রতিশ্রুত ভূমিতে একটি তাবু বা কুঁড়ে ঘর তৈরি করে বাস করতে বলা হয়, আমি রাজি কিন্তু ও রাজি হবে না। শুধু আমি কেন, দুনিয়ার সব প্রকৃত প্রেমিক পুরুষ আসলে সমাজ সংসার ত্যাগ করে শুধু প্রেমিকার সাথে শূণ্য হতে বেরিয়ে পড়তে রাজি, বহু রাজাও করেছে এমন প্রেমের জন্য রাজ্য তাগ কিন্তু প্রমিকারা সবাই রাজপ্রাসাদ চায়। আব্রাহামিক ধর্মগুলোর প্রতিদর্শন আসলে মেয়েরা একেবারেই পছন্দ করে না। এর কারণ তাদের সন্তানের কল্যান চিন্তা। দৈন্যতা, অনাহার আর ক্ষুধায় নিজের সন্তানকে কেউ নিয়ে যেতে চায় না।
আমি তাকিয়ে আছি দেখে মেয়েটা বলল: “অনেক কিছু ভাবছেন মনে হয়”
আমি বললাম: “হ্যঁ”
মেয়েটা বলল: “কি?”
আমি বললাম: “তোমাকে নিয়ে পালাবার চিন্তা করছি”
মেয়েটা বলল: “ধুর, আপনি পারবেন না”
আমি বললাম: “হ্যঁ, ভয় পাচ্ছি”
মেয়েটা বলল: “কিসের ভয়?”
আমি বললাম: “কাল রাতে কী সব চেয়েছ সারা রাত নামাজ পড়ে, কাউকে পছন্দ হয়েছে?”
মেয়েটা বলল: “ধুর, ওটা অন্য”
আমি বললাম: “কী সেটা?”
মেয়েটা বলল: “প্রফেশনাল”
আমি বললাম: “প্রমোশন, বেতন বোনাস?”
মেয়েটা বলল: “না, বাইরে চলে যাব”
আমি বললাম: “তোমার মনের আশা পূর্ণ হোক, খুব মজা হবে”
মেয়েটা বলল: “কি মজা?”
আমি বললাম: “আমি বিদেশে যাব তোমার সাথে দেখা করতে”
মেয়েটা বলল: “হ্যাঁ, তখন আমরা বেড়াব, যেদিকে ইচ্ছা চলে যাব ঘুরতে, আপনার সাথে একসাথে থেকে দিনের পর দিন কোন পিছুটান ছাড়া ঘুরতে আমার খুব সখ হয়”
আমি বললাম: “সেটাতো এখনও পার”
মেয়েটা বলল: “না, পারি না, মাথা খারাপ? বাসায় যেতে রাত আটটার বেশি বাজলে আমার উপর গজব নেমে আসে”
আমি বললাম: “সেই জন্যইতো বলছি চল পালিয়ে যাই”
মেয়েটা বলল: “আমার সেই সাহস নাই”
নাস্তা করা শেষ হলে বেয়ারা এসে বলল “সার চা?”
আমি বললাম “হ্যাঁ দুটো, চিনি কম”
চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব সারা দিনের জন্য। যেটি ও করতে চায় দিনের পর দিন, সেটি অন্তত আর এক দিনের জন্য ওর জীবনে সত্য হোক। আমাকে ও এত পছন্দ করে এর কারন মনে হয় ও বুঝতে পারে সব কিছু থেকেও আমার মধ্যে এক ধরণের বৈরাগ্য আছে। ও নিজেও যেন কিছুটা এরকম। আমার মনে হয় ভালবাসা বিষয়টাই একটা এস্কেপেড, একটা মানসিক মুক্তি জগতের সব জটিলতা আর দায়িত্ব থেকে। বৈরাগ্য যাদের মনে নেই তারা সব কিছু পেয়েও কখনও সেই ভালবাসার নাগাল পায় না। আর বৈরাগ্য যাদের আছে তারা কিছু না পেয়েও শুধু ভালবাসার অদৃশ্য ফোর্স ফিল্ড তাদের বাঁচিয়ে রাখে, উদ্বুদ্ধ করে কল্যানে এবং নতুন কিছুতে।
রেস্তোরা ছেড়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে আমরা কাপাসিয়ার দিকে রওয়ানা দেই বনের মাঝ দিয়ে যেন হাওয়ায় ভেসে ভেসে। মনে হতে থাকে পরিবার সমাজ ওর উপর যে কঠিন ধর্মের শৃঙ্খল পরিয়ে রেখেছে সেই ধর্ম জরাথুস্ত্রবাদের আহুরা মাজদা বা বেদ উপনিষদের ব্রহ্মের সেই সচ্চিতানন্দের ধর্ম নয়। আবার আব্রাহামিক দর্শনের জীবন বিরোধী পরকালমুখি নগর সভ্যতাবিরোধী ধনী জীবনের বিলাস বিমূখ সিমপ্লিসস্টিক হবার এন্টিনোমির ধর্মও নয়। নিজেরা শোষিত, নিপিড়িত ও দাসসম হলেও ধনী সমাজকে অপছন্দ করে না এ যুগের মানুষ। বরং উল্টো সবাই ধনী হতে চায়। ধনী জীবনই এখন লক্ষ্য। পরিবার সমাজ সবাই শতভাগ ধন দৌলত, ক্ষমতা ও বিলাসের পেছনেই সর্বক্ষনের জন্য নিয়োজিত। তাহলে ওর উপরে চাপিয়ে দেওয়া আমাদের সমাজের যে ধর্ম, সেটা কিসের প্রতিদর্শন? সেটা পরের পর্বে।
©Sirajul Hossain
Art: pedrum/deviantart

