সভ্যতার শুরু থেকে গোত্রপ্রধান ও পরবর্তিতে রাজা-মহারাজারা যারা আইন প্রয়োগ করত তারা সকলে ছিল সকল আইনের ঊর্ধ্বে। আইন কানুন ছিল শুধুই প্রজাদের জন্য। গোত্রপ্রধান বা রাজা-মহারাজা, আইনের আওতার বাইরের এইসব সার্বভৌম ব্যক্তিদের আইনি ভাষায় বলা হয় আইনের উৎস (Fount of Justice)।
মানুষ যখন প্রকৃতিনির্ভর ছিল যেমন চাষাবাদ করা, শিকার বা বন, খনি বা নদী থেকে সম্পদ আহরণ করে বেঁচে থাকা ইত্যাদি তখন এটাও মনে করা হত যে জমি, বন, খনি বা নদী এগুলো সব রাজা বা রানির সম্পদ। তাঁরা জনগনকে দয়া করে অধিকার দেন কৃষি উৎপাদন বা সম্পদ আহরণের এবং তার বিনিময়ে তাঁরা কর নেন। আইন কানুনের তখন প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজা বা রানির কল্যান, তাদের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ও তাদের সম্পদের নিরাপত্তা দেওয়া। আইনগুলোর উদ্দেশ্য (ইনটেন্ট) ছিল সেগুলো রক্ষায় পুলিশগীরি করা।
মধ্যযুগে এসে দেখা গেল নিজের দেশের জমি, বন, খনি বা নদী এগুলো থেকে সম্পদ আহরণই রাজ্যের জন্য যথেষ্ট নয় কারণ পুলিশগীরির খরচ অনেক। তখন মুক্ত করে দেওয়া হল সমরাস্ত্র ও বড় বড় জাহাজ বানিয়ে ভিন্ন দেশ আক্রমণ করে সেই দেশের জমি, বন, খনি বা নদী থেকে সম্পদ আহরণ এমনকি মানুষদেরও দাস বানিয়ে তাদের খাটিয়ে সম্পদ আহরণ।
এটারই আধুনিক রূপ হল গত কয়েক শতকের উপনিবেশবাদ বা কলোনিয়ালিজম। উপনিবেশকারি ও উপনিবেশকৃতদের জন্য আইন এক ছিল না। উপনিবেশের আইন কানুনেরও প্রধান লক্ষ্য ছিল উপনিবেশকারি রাজা/রানির কল্যান ও উপনিবেশ থেকে প্রাপ্ত সম্পদের নিরাপত্তা প্রদান। সেই আইনগুলোর উদ্দেশ্যও (ইনটেন্ট) ছিল রাজ সম্পদ আহরণ ও রক্ষায় পুলিশগীরি করা।
শিক্ষাবিপ্লব, শিল্পবিপ্লব ও শ্রমবিপ্লবের পর আর্থিকভাবে উপনিবেশকারী উন্নত দেশগুলোর সরকারী ব্যয় এত বৃদ্ধি পেল যে নিজের দেশের সম্পদতো নয়ই, উপনিবেশগুলোর সম্পদ আহরণেও তাদের প্রয়োজন মিটছে না। তার ফলে শুরু হল উন্নত সব অস্ত্রশস্ত্রসহ নানা দেশের সাথে নিয়মিত লড়াই বিবাদ ও দখলের প্রতিযোগিতা। যে লড়াইয়ের চুড়ান্ত হল গত শতাব্দীর দুটো বিশ্বযুদ্ধ। এই বিশ্বযুদ্ধ দুটোতে উপনেবিশকারী রাষ্ট্রগুলোর এত ক্ষয়ক্ষতি হল যে তারা বুঝতে পারল যে ভৌত সম্পদ নিয়ে কাড়াকাড়িতে বৃহৎশক্তিদের লড়াই মানে স্রেফ আত্মহত্যা।
অপরদিকে এটাও দেখা গেল বস্তু নিয়ে ব্যবসার চাইতে সেটাতে জ্ঞান ও উদ্ভাবন যোগ করা (intellectual value addition) অনেক বেশি লাভজনক। আন্তর্জাতিক ব্যবসা প্রসারের পর দেখা গেল অপর দেশ দখল না করে তার বাজার দখল করলেই তো চলে। এটাও দেখা গেল দেশে সামাজিক নীতি ও আইনগুলো পুলিশগীরি করার জন্য প্রণীত সেই সব দেশ জ্ঞান ও উদ্ভাবন পিছিয়ে থাকে। তাই তারা আন্তর্জাতিক ব্যবসা বানিজ্যের যে পন্য সেটাতে যথেষ্ট জ্ঞান ও উদ্ভাবন কেন্দ্রীক মূল্য সংযোজন করতে পারে না। জ্ঞান ও উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজন নিঃশঙ্ক চিত্ত। রাষ্ট্র ও সম্পদ রাজার, আমি শুধু শ্রমিক এই চিন্তায় আবদ্ধ মন উদ্ভাবনের ঝুঁকি নেয় না। নিজের জীবনকে নিজের খাস না ভাবলে বা ওউন না করলে সে নতুন কিছু করে না। নিয়ম, নীতিতে ঘেরা পুলিশি রাষ্ট্র দাস মানসিকতার আরো শ্রমিক তৈরি করে, উদ্ভাবক নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর সারা দুনিয়ার নিরাপত্তা ও মানব উন্নয়নের শিক্ষাগুলোকে ছড়িয়ে দেবার জন্য নতুন করে তৈরী হল জাতিসমুহের সংঘ বা জাতিসংঘ। জাতিসংঘের তত্বাবধানে তৈরি করা হল নানা দেশের রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, সমরবিদ, অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিকেরা মিলে বেশকিছু আন্তর্জাতিক আইন, নীতিমালা ও দিগদর্শন যেগুলোকে বলা হয় ইউ এন চার্টার। এর সাথে ঘোষণা করা হল সারা দুনিয়ার মানব উন্নয়নের সামগ্রিক মানবাধিকার নীতিমালা (Universal Declaration of Human Rights)। অর্থাৎ এই দুনিয়ার যে কোন মানুষকে যেটুকু অধিকার দিতেই হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ৫১টি দেশ জাতিসংঘ সনদগুলোতে স্বাক্ষর করে এবং পরিবর্তিতে ১৯৩টি দেশ এর সদস্য হয়। এইসব দেশ কমবেশি জাতিসংঘ সনদগুলো মেনে চলার অঙ্গীকার করে এবং তাদের দেশের সংবিধান ও আইনগুলো এমনভাবে তৈরি বা রূপান্তর করার অঙ্গীকার করে যে সকল মানুষের জন্য নিম্নতম কিছু মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে এবং কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না।
এর সাথে আইনগুলোর লক্ষ্য হবে সর্বজনীন কল্যাণ, যার উদ্দেশ্য মানুষের অধিকার রক্ষা, পুলিশগীরি করা নয়। যেমন চোর ধরা হবে ও তাকে শাস্তি দেওয়া হবে চুরি করা মন্দ সেই কারণে নয়। অথবা কেউ খারাপ কাজ করছে বলে তাকে শাস্তি দেবার জন্য নয়। চোর ধরা ও তাকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্য সম্পদের মালিক যে তার অধিকার রক্ষার জন্য। স্বামীর পরকীয়া ধরা পড়লে তাকে অভিযুক্ত করা হবে এই কারণে নয় যে পরকীয়া কার পাপ বা মন্দ। তাকে অভিযুক্ত করা হবে এই কারণে যে তার স্ত্রী বিবাহিতার অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। এগুলোই হচ্ছে রাষ্ট্রের নৈতিক পুলিশগীরি থেকে বের হয়ে এসে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেওয়ার পথ।
বাংলাদেশ একটি নতুন রাষ্ট্র। তাই তার আছে একটি আধুনিক ও অসাধারণ সংবিধান। যে সংবিধানে এই অধিকার ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রের নীল নকশা রয়েছে। যেখানে সবকিছুর কেন্দ্র মানুষ, মানুষের কল্যাণ ও মানুষের অধিকার। এই সংবিধানটির যে উচ্চ মূল্য সেটা আমরা এখনও অনেকেই বুঝি না। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, যারা আজ সংসদ সদস্য তাদের বেশিরভাগই এর মর্ম বোঝেন না। বাংলাদেশের অস্ত্রধারী বাহিনীগুলো, যাদের পবিত্র দায়িত্ব এই সংবিধান রক্ষা করা, তারা সবার আগে জাতির পিতাকে হত্যা করে এই সংবিধান কলুষিত করার চেষ্টা করেছে।
স্বাধীনতার আজ ৫০ বছর পর বিনা বিচারে মানুষ হত্যা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে বিদেশী রাষ্ট্র তাদের নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। এদেশের আইন বিভাগ বিচার বিভাগ যারা যারা পরিচালনা করেন তারা কতটা আইনের উদ্দেশ্য বা ইনটেন্ট সম্পর্কে অবগত সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আধুনিক রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি সম্পর্কে এদেশে এখন সবাই অজ্ঞ এটা নিশ্চিত।
যে কারণে এদেশে সকল আইন কানুনের লক্ষ্য পুলিশগীরি হয়ে যাচ্ছে। আইন কানুনের লক্ষ্য পুলিশগীরি করা হলেই সেই সমাজে জ্ঞান ও উদ্ভাবনের যোগ হ্রাস পেতে থাকে। আইন মান্যকারী মানুষ সবরকম ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। শুধু অপরাধমনস্করা বা কোন কিছু কেয়ার করে না যারা তারা ঝুঁকি নেয়। যার লক্ষ্য হয় শুধুই অর্থ। যার ফলে ফটকা ও বাটপারি ব্যবসায় ভরে যায় সমাজ।
আমাদের এই আধুনিক সংবিধান এসেছে রাষ্ট্র পরিচালনায় আধুনিক যুক্তরাজ্যের মেধা ও জ্ঞান-দর্শন থেকে। আধুনিক যুক্তরাজ্য সাংবিধানিক রাজতন্ত্র এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের মিশ্রিত দেশ হলেও রাজতন্ত্র সেখানে অনেকটা আলঙ্কারিক। তার পরও আইনের উৎস (Fount of Justice) হিসাবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন দেশের প্রায় ১৬০টি আইনের আওতামুক্ত। ১৯৫২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যুক্তরাজ্যের এবং যুক্তরাজ্য ছাড়াও আরও প্রায় ৩২ টি দেশের রানি ছিলেন।
১৬০টি আইনের আওতামুক্ত থাকলেও তার ৭০ বছরের বেশী রাজত্বকালে তিনি কখনও কোন আইনের অবমাননা করেননি। কেন করেননি কারণ খুব স্পষ্ট। এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন “আমাদের অনেকের কাছেই আমাদের (ধর্ম) বিশ্বাসের মৌলিক গুরুত্ব রয়েছে। আমার জন্য খ্রীষ্টের প্রদত্ত শিক্ষা এবং ঈশ্বরের সামনে আমার নিজের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা একটি কাঠামো প্রদান করে। যে কাঠামোর ভেতরে থেকেই আমি আমার জীবন পরিচালনা করার চেষ্টা করি।” এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে “ঈশ্বরের সামনে আমার নিজের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা” কথাটি। নিজের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার বিষয়ে ঈশ্বরের সামনে যে সৎ, নিজের পদের জন্যও সে সৎ এবং তার জনগণের জন্যও সে সৎ।
আইনের উৎস বা ফাউন্ট অব জাস্টিস হওয়া সত্বেও আমরা দেখছি ঈশ্বরের সামনে নিজের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার জন্য মানুষ আইনবিরুদ্ধ কিছুই করে না। আর আমাদের দেশে আমরা দেখছি পদ্মা সেতুর উপর সেলফি তোলার মত অপ্রয়োজনীয় কাজেও নেতা নেত্রীরা, দেশের আইন ও সংবিধান রক্ষায় যারা শপথে আবদ্ধ তারাও নিজেদের ঘোষণা করা আইন ভাঙ্গছেন। তাঁরা হয়ত মানুষকে দেখাতেই চাইছেন যে তাঁরা আইনের উৎস, তাঁরা ফাউন্ট অব জাস্টিস। যে তারা এদেশের গোত্রপ্রধান বা রাজা-মহারাজা।
কয়েক শতকের উপনিবেশবাদ বা কলোনিয়ালিজম এবং দুটো বিশ্বযুদ্ধ আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছে তার ফসলই যেন ছিল গণমানুষের অধিকারের শপথে গঠিত আধুনিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশের সংবিধানে ছিল সেই মানব উন্নয়নের গুপ্ত সোনালী সূত্র যার ফলে এদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করা যেত। সেই সোনার বাংলার রূপকার বঙ্গবন্ধু জানতেন সেই ভাষা। সেই স্পিরিটটাকে হত্যা করে সেই ভাষা জানা সবাইকে একে একে রাজনীতি থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। পুলিশ মিলিটারি আমলারা সেই ভাষা পড়তে অক্ষম। তারা এখনও বুঝতেই পারছে না কেন তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে একটি দেশে।
আমি মোটেও আশ্চর্য নই কেন আমরা মুক্ত গণতন্ত্র থেকে ফিরে চলেছি কলোনিয়াল দাসপ্রথার নীল চাষের পুলিশি রাষ্ট্রের দিকে। স্থপতির নীল নকশার ভাষা যদি নির্মাতারা পড়তে না পারে তাহলে কি হতে পারে?

